জমি হাঙ্গরদের দাপটে ভূতেরা কোথায় হারিয়ে গেল?


আজকাল শহরের চারপাশে চোখ রাখলেই দেখা যায় উঁচু-উঁচু বিল্ডিং, চকচকে শপিং মল, আর অত্যাধুনিক কমপ্লেক্স। কিন্তু এই সবের পিছনে লুকিয়ে আছে একটা গভীর গল্প – ভূতের গল্প। হ্যাঁ, ঠিক শুনেছেন। একসময় যে জায়গাগুলোকে মানুষ ভয়ে এড়িয়ে চলত, সেগুলো এখন জমি হাঙ্গরদের লোভের শিকার। প্রোমোটাররা যেন কোনো যাদুমন্ত্রে রাতারাতি ভূতুড়ে বাড়ি, ভয়ঙ্কর পুকুর, জলা জমি, আগাছার জঙ্গল, ঘন বাঁশবন এমনকি শ্মশান পর্যন্ত সবকিছুকে পরিণত করছে মাল্টি-স্টোরি অ্যাপার্টমেন্টে। ভূতেরা কোথায় যে হারিয়ে গেল, তা বোঝার উপায় নেই। নাকি তারা এখনও আছে, শুধু আমরা দেখতে পাচ্ছি না?
আসুন শুরু করি শহরের প্রান্ত থেকে। কলকাতার কাছাকাছি অনেক জায়গায় এখনও পুরোনো জমিদার বাড়ি আছে। এই বাড়িগুলো একসময় রাজকীয় ছিল, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে পরিত্যক্ত হয়ে গেছে। লোকমুখে শোনা যায়, এখানে ভূতের দৌরাত্ম্য চলে। রাতের বেলা অদ্ভুত আওয়াজ, ছায়ামূর্তি দেখা যায়। কিন্তু জমি হাঙ্গররা কি থামে? না। তারা এই বাড়িগুলোকে কিনে নেয়, ভেঙে ফেলে, আর নতুন প্রজেক্ট শুরু করে। উদাহরণস্বরূপ, হুগলির একটা পুরোনো জমিদার বাড়ি। সেখানে লোকজন বলে, বাড়ির মালিকের আত্মা এখনও ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু এক প্রোমোটার এসে বাড়িটা কিনে নিল। শুরু হলো নির্মাণকাজ। কিন্তু কাজ চলাকালীন অদ্ভুত ঘটনা ঘটতে লাগল। শ্রমিকরা বলে, রাতে যন্ত্রপাতি নিজে নিজে চালু হয়ে যায়, অথবা অদৃশ্য হাতে কেউ ধাক্কা দেয়। তবু প্রোমোটার থামেনি। আজ সেখানে একটা বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট দাঁড়িয়ে আছে। ভূতেরা কি চলে গেল? নাকি তারা এখন ফ্ল্যাটের ভিতরে লুকিয়ে আছে?
এবার আসি পুকুরের কথায়। বাংলার গ্রামে-শহরে পুকুর তো অজস্র। কিন্তু কিছু পুকুর আছে যা ভয়ঙ্কর। যেমন, হুগলির ঘোষেদের ডোবা। জনশ্রুতি আছে, এখানে পরপর কয়েকজন ডুবে মরেছে। লোক বলে, পুকুরে একটা অভিশাপ আছে। দীর্ঘদিন কেউ ধারেকাছে যেত না। কিন্তু এক জমি হাঙ্গরের নজর পড়ল। পাড়ার মাতব্বরদের সাহায্য নিয়ে পুকুর বুজিয়ে দিল। শুরু হলো ইমারতের কাজ। কিন্তু পরে কী হল? বিল্ডিং বেচা গেল কি না, তা জানা নেই। কিন্তু লোকমুখে শোনা যায়, নতুন বাসিন্দারা রাতে অদ্ভুত স্বপ্ন দেখে – জলের মধ্যে ডুবে যাওয়ার স্বপ্ন। ভূতেরা কি সত্যি চলে গেল, নাকি তারা মাটির নিচে লুকিয়ে আছে?
জলা জমি আর আগাছার জঙ্গলও বাদ যাচ্ছে না। একসময় এই জায়গাগুলোতে সাপ-খোপ, বাঘ-ভালুকের ভয় ছিল, কিন্তু তার চেয়ে বেশি ছিল ভূতের ভয়। রাতে যেন অদৃশ্য প্রাণী ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু এখন? প্রোমোটাররা এই জমিগুলো কিনে নেয়, পরিষ্কার করে, আর শপিং মল বানায়। উদাহরণ দেই, সুন্দরবনের কাছাকাছি একটা জলা জমি। লোক বলে, সেখানে একটা পুরোনো জাহাজ ডুবে গিয়েছিল, আর তার ভূত এখনও আছে। কিন্তু এক কোম্পানি এসে জমি কিনল, বুজিয়ে দিল, আর একটা রিসর্ট বানাল। এখন সেখানে টুরিস্টরা আসে, কিন্তু কেউ কেউ বলে, রাতে সমুদ্রের আওয়াজ শোনা যায় – যেন ডুবে যাওয়া জাহাজের কান্না।
ঘন বাঁশবনের কথা বলি। বাংলার গ্রামে বাঁশবন মানে ভয়ের জায়গা। বাতাসে বাঁশের শব্দ যেন ভূতের হাসি। কিন্তু জমি হাঙ্গররা এগুলো কেটে ফেলে, ফ্ল্যাট বানায়। একটা উদাহরণ, বর্ধমানের একটা বাঁশবন। সেখানে লোক বলে, একটা বাঘের ভূত আছে। কিন্তু প্রোমোটার এসে কেটে ফেলল, আর একটা হাউজিং কমপ্লেক্স বানাল। এখন সেখানে লোক থাকে, কিন্তু রাতে যেন বাঁশের শব্দ শোনা যায় – অদৃশ্য।
শ্মশানের কথা তো আরও ভয়ঙ্কর। শ্মশান মানে মৃত্যুর জায়গা। লোক বলে, সেখানে আত্মারা ঘুরে। কিন্তু এখন? কিছু শহরে শ্মশানের জমি কিনে নেয়া হচ্ছে, সিনেমা হল বানানো হচ্ছে। উদাহরণ, কলকাতার একটা পুরোনো শ্মশান। প্রোমোটার এসে কিনল, বানাল একটা মাল্টিপ্লেক্স। এখন সেখানে লোক সিনেমা দেখে, কিন্তু কেউ কেউ বলে, স্ক্রিনে অদ্ভুত ছায়া দেখা যায়।
তবে ভূতেরা যে একদম নেই, তা বলা যাবে না। এখনও কিছু জায়গা আছে যেখানে ভূতের দৌরাত্ম্য চলে। যেমন, পুরোনো হাসপাতালের মর্গ। সেখানে গেলে গা ছমছম করে। অথবা প্রাচীন রেল স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম। পুরোনো টিকিটঘরে যেন অদৃশ্য যাত্রী অপেক্ষা করে। বহুদিন বন্ধ স্কুল বাড়িতে পরিবেশ এমন যেন শিশুদের হাসি শোনা যায়। অথবা বন্ধ কলকারখানায় অস্ফুট আওয়াজ। এই সব জায়গায় ভূতেরা এখনও আছে। কিন্তু কতদিন? জমি হাঙ্গররা তো চোখ রেখেছে।
একটা উদাহরণ দেই। কলকাতার একটা পুরোনো জমিদার বাড়ি। সেখানে লোক বলে, বাড়ির মালিকের স্ত্রীর ভূত আছে। অনেক অলৌকিক ঘটনা ঘটেছে। বাড়িটা কেনা তো দূর, ভাড়া নিতেও কেউ চায় না। প্রোমোটাররাও সাহস পাচ্ছে না, কারণ বুকিং না হলে লস। কিন্তু কতদিন এরকম থাকবে?
আরেকটা উল্টো উদাহরণ। হুগলির ঘোষেদের ডোবা। পুকুর বুজিয়ে বিল্ডিং বানাল, কিন্তু বেচা গেল কি না জানা নেই। হয়তো ভূতেরা প্রতিশোধ নিয়েছে।
সব মিলিয়ে, মানুষের লোভে আসল ভূতেরা পগারপার। কিন্তু ভাবুন তো, এই নতুন বিল্ডিংগুলোতে যদি ভূতেরা থাকে? রাতে অদ্ভুত আওয়াজ, ছায়া – তাহলে কী হবে? আমরা যেন ভুলে যাচ্ছি, প্রকৃতি আর অলৌকিকের সাথে খেলা করা ঠিক নয়। জমি হাঙ্গরদের দাপটে ভূতেরা হারিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু তারা ফিরে আসতে পারে – অন্য রূপে।
এখন প্রশ্ন হলো, আমরা কী করব? ভূতের গল্প শুনে হাসব, নাকি সতর্ক হব? বাংলার ঐতিহ্য, পুরোনো জায়গাগুলো রক্ষা করা দরকার। নাহলে ভূতেরা নয়, আমরাই হারিয়ে যাব।
নারায়ণ রতন দত্ত -- সাংবাদিক /হাওড়া


Address
3721 2nd Street
Saltlake Sector V, Kolkata 700 091
Contacts
+91 98300 71925
Contract.subhendu.etv@gmail.com