শিলিগুড়ির ‘চিকেনস নেক’ কী? গুরুত্ব, চ্যালেঞ্জ এবং ভারত সরকারের পদক্ষেপ

শিলিগুড়ি, পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত একটি সংকীর্ণ ভূখণ্ড যা ভারতের মানচিত্রে ‘চিকেনস নেক’ বা মুরগির গলার মতো দেখায়। এটি শিলিগুড়ি করিডর নামে পরিচিত, যা মাত্র ২০-২২ কিলোমিটার চওড়া এবং ৬০ কিলোমিটার লম্বা। এই করিডরটি ভারতের মূল ভূখণ্ডকে আটটি উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যের (আরুনাচল প্রদেশ, আসাম, মণিপুর, মেঘালয়, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড, সিকিম এবং ত্রিপুরা) সঙ্গে সংযুক্ত করে। নেপাল পশ্চিমে, বাংলাদেশ দক্ষিণে এবং উত্তরে ভুটান-চীন সীমান্তের কাছে অবস্থিত এই অঞ্চলটি ভারতের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত সংবেদনশীল। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর এই করিডরের সৃষ্টি হয়েছে, যা ভারতের ভৌগোলিক অখণ্ডতার চাবিকাঠি।

চিকেনস নেকের গুরুত্ব অপরিসীম। এটি শুধুমাত্র স্থলপথে উত্তর-পূর্ব ভারতের সঙ্গে বাকি দেশের যোগাযোগ রক্ষা করে না, বরং বাণিজ্য, পরিবহন এবং সামরিক লজিস্টিকসের কেন্দ্রবিন্দু। শিলিগুড়ি শহর এখানকার প্রধান জংশন, যেখান থেকে রেল, সড়ক এবং বিমানপথ (বাগডোগরা বিমানবন্দর) উত্তর-পূর্বে যায়। এটি ভুটান, নেপাল এবং বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্যের ট্রানজিট পয়েন্ট। অর্থনৈতিকভাবে, এখান দিয়ে পাস করে চা, তেল এবং অন্যান্য পণ্যের বিনিময়। সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে, এটি ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্ব কমান্ডের মূল অংশ; সিকিম এবং আরুনাচলের সীমান্তে সৈন্য পাঠানোর একমাত্র পথ। যদি এই করিডরটি অবরোধিত হয়, তাহলে ৪৫ মিলিয়ন মানুষের উত্তর-পূর্বাঞ্চল বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে, যা জাতীয় সংকট সৃষ্টি করবে। ১৯৬২ সালের চীন যুদ্ধ থেকে এর দুর্বলতা স্পষ্ট, যখন চীন এটিকে আক্রমণের লক্ষ্য করেছিল।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এর ভূ-কৌশলগত চ্যালেঞ্জ বেড়েছে। চীনের চুম্বি উপত্যকা থেকে সামরিক উন্নয়ন, যেমন রাস্তা এবং বিমানঘাঁটি নির্মাণ, এই করিডরকে হুমকির মুখে ফেলেছে। ২০১৭ সালের ডোকলাম সংঘাতে চীন ভুটানে রাস্তা তৈরি করে করিডরটিকে দুর্বল করার চেষ্টা করেছিল। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন নেতা মুহাম্মদ ইউনুসের সাম্প্রতিক চীন সফরে উত্তর-পূর্ব ভারতকে ‘ভূ-অবরুদ্ধ’ বলে মন্তব্য করা এবং লালমনিরহাটে চীন-সাহায্যে বিমানঘাঁটি নির্মাণের পরিকল্পনা ভারতকে উদ্বিগ্ন করেছে। ২০২৫ সালের এপ্রিলে চীনা কর্মকর্তারা লালমনিরহাট পরিদর্শন করেছেন, যা করিডরের কাছে চীনা উপস্থিতি বাড়ানোর ইঙ্গিত। পাকিস্তান-সমর্থিত গোয়েন্দা কার্যকলাপ এবং সীমান্তবর্তী অবৈধ বাণিজ্য, মাদক পাচারও চ্যালেঞ্জ। অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা ইউনুসের মন্তব্যকে ‘আক্রমণাত্মক’ বলে সমালোচনা করেছেন, এবং বাংলাদেশের দুর্বলতা তুলে ধরেছেন।

ভারত সরকার এই হুমকি মোকাবিলায় সক্রিয়। ২০২৫ সালে রাশিয়ান এস-৪০০ ট্রায়াম্ফ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম, রাফাল ফাইটার জেট (হাসিমারা এয়ারবেসে) এবং ব্রহ্মোস ক্রুজ মিসাইল মোতায়েন করা হয়েছে। ত্রিশক্তি কর্পস (সুকনায় অবস্থিত) এলাকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করে, যাতে উন্নত অস্ত্র এবং ড্রোন নজরদারি রয়েছে। সামরিক মহড়া যেমন ‘তিস্তা প্রহার’ (মে ২০২৫) চিকেনস নেকের কাছে অনুষ্ঠিত হয়েছে, যাতে ট্যাঙ্ক, ড্রোন এবং যৌথ যুদ্ধকৌশল প্রদর্শিত হয়েছে। অবকাঠামো উন্নয়নে, ২২,৮৬৪ কোটি টাকার ১৬৬.৮ কিমি লম্বা চার-লেন হাইওয়ে (এনএইচ-৬, শিলং থেকে সিলচর) অনুমোদিত, যা করিডরের উপর নির্ভরতা কমাবে। বিহারের জোগবানী থেকে নেপালের বিরাটনগর হয়ে নতুন রেল লাইন এবং বাংলাদেশের মাধ্যমে অলটারনেটিভ রুট তৈরি হচ্ছে। কেন্দ্রীয় সেনা, বিএসএফ এবং পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের যৌথ অভিযান বাড়ানো হয়েছে, বিশেষ করে ভারত-পাক উত্তেজনার পর। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাইএমএসটিইসি সম্মেলনে বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করেছেন।

চিকেনস নেকের নিরাপত্তা ভারতের জাতীয় একতার প্রতীক। চীন এবং বাংলাদেশের গতিবিধি সত্ত্বেও, ভারতের প্রস্তুতি এটিকে অটুট রাখবে। এই করিডরটি শুধু যোগাযোগের সেতু নয়, বরং ভারতের ভবিষ্যতের নিরাপত্তার চাবিকাঠি। সরকারের পদক্ষেপগুলো এর দুর্বলতা কমিয়ে শক্তিশালী করছে, কিন্তু কূটনৈতিক সতর্কতা অব্যাহত রাখতে হবে।

Address

3721 2nd Street
Saltlake Sector V, Kolkata 700 091

Contacts

+91 98300 71925
Contract.subhendu.etv@gmail.com