ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আদৌ কি সম্ভব?

আমিনুল ইসলাম, ঢাকা, ২৬ সেপ্টেম্বর

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস যুক্তরাষ্ট্র সফর কালেও ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচনের কথা বলেছেন। অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘আগামী সাধারণ নির্বাচন ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে অনুষ্ঠিত হবে। এটি শুধু একটি নির্বাচন নয়, এটি দেশের গণতন্ত্রে একটি নতুন যুগের সূচনা করবে।’ কিন্তু তারপরেও সন্দেহ থেকে যাচ্ছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের সম্ভাবনা নিয়ে। আশঙ্কা যে অমূলক নয়, সেটা বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতারাই তাঁদের ভাষণে প্রকাশ করছেন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলে যেভাবে ধর্মীয় মৌলবাদ মাথাচাড়া দিয়েছে, তাতে করে বাংলাদেশে সুস্থ গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরে পাওয়া মোটেই সম্ভব নয় বলে অনেকে মনে করেন।

বাংলাদেশে আগামী সাধারণ নির্বাচন কী পদ্ধতিতে হবে সেটাই এখনও স্পষ্ট নয়। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে উঠে আসা জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপির নেতারা চাইছেন আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক বা পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন। জামায়াত-সহ বেশ কয়েকটি মৌলবাদী সংগঠনও চাইছে পিআর পদ্ধতি। কিন্তু জাতীয় সংসদ না থাকায় কোন্ আইনে পিআর পদ্ধতিতে বৈধ নির্বাচন হবে তা নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন সংবিধান বিশেষজ্ঞরা। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেছেন, ‘পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের মাধ্যমে দলীয় ও ব্যক্তি স্বৈরতন্ত্র চালু হবে’। ইতিমধ্যেই ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদের ভোটে জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ছাত্র শিবিরের কাছে গোহারা হেরেছে বিএনপির ছাত্র দল। রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েও চলছে শিবিরেরই দাপট। তাই আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে সাধারণ নির্বাচন হলেও বিএনপির জেতার সম্ভাবনা কতোখানি তা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে বিভিন্নমহলে। এই আলোচনাকে অবশ্য গুরুত্ব দিতে নারাজ দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। নির্বাচনে জয়লাভ করে তাঁদের সরকার গঠন প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘বিএনপি আগেও করেছে (সরকার), আবারও করতে পারবে। আমাদের আছে অভিজ্ঞতা ও সাফল্যের ইতিহাস। হাসিনার ধ্বংসযজ্ঞের পর বাংলাদেশ আর কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা সহ্য করতে পারবে না। এই দেশ কোনো টেস্ট টিউব বা ল্যাবরেটরি নয়।’ তিনি বুঝিয়ে দেন পিআর পদ্ধতি কিছুতেই মানবে না তাঁদের দল। তবে জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমানের মতে, ‘সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য মানসিকতা পরিবর্তন প্রয়োজন। বড় প্রমাণ ডাকসু এবং জাকসু। পরাজিতরা ফল মানতে চায়নি। নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে বলে ফল পাল্টে দেওয়ার চেষ্টা কাজ হয়নি। পিআর পদ্ধতিতে একক প্রার্থী থাকবে না বলে, ফল পাল্টে ফেলা বা কেন্দ্র দখল থাকবে না'। জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির লড়াই বেশ জমে উঠেছে। বিভিন্ন জায়গায় শুরু হয়েছে রাজনৈতিক সঙ্ঘর্ষও।

এদিকে, বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে নির্বাচন কমিশন ১৫০টি প্রতীকের একটি তালিকা প্রকাশ করেছে। সেখানে নেই আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক। আবার এনসিপির আবেদনে তাদের শাপলা মার্কা দেওয়া হয়নি। তাই ক্ষুব্ধ এনসিপি নেতা সারজেস আলম তাঁর ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে একগুচ্ছ প্রশ্ন তুলছেন নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে। তাঁর প্রশ্ন, 'যেদিন এনসিপি প্রথম নিবন্ধনের জন্য আবেদন করে সেদিনই স্পষ্ট ভাবে জানিয়ে দিয়েছিল এনসিপি শাপলা মার্কা চায়। তাহলে ওই তালিকায় শাপলা মার্কা যুক্ত করা কাদের কাজ ছিল? এতদিন কি তারা নির্বাচন কমিশনে বসে বসে নাটক দেখেছে? নাকি স্বাধীন প্রতিষ্ঠানে বসে অন্য কোন প্রতিষ্ঠান, দল বা এজেন্সির কথামতো উঠবস করেছে?'

নির্বাচন যে সকলের অংশগ্রহণমূলক হবে না সেটাও বুঝিয়ে দিয়েছেন সারজিস। তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশের কোনো নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ নিতে পারবে না। দল হিসেবে তাদের বিচার হবে এবং নিষিদ্ধ করা হবে। ফ্যাসিস্ট ও ছাত্র-জনতা কখনো একসাথে চলতে পারে না, পারবেও না।’ শুধু আওয়ামী লীগই নয়, বিএনপিকেও সতর্ক করে দিয়ে এনসিপির হুংকার, ‘জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে আগামীর বাংলাদেশে কেউ রাজনীতি করতে পারবে না।’

তবে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের মনে করেন, আওয়ামী লীগ-সহ সব দল অংশ নিলে গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে আগামী নির্বাচনের। তিনি বলেছেন, ‘জামায়াতকে যখন নিষিদ্ধ করা হয়েছিল তখনও আমরা বাধা দিয়েছি। এগুলো দেশের জন্য মঙ্গল বয়ে আনেনি। সবাইকে নিয়ে নির্বাচন না করলে নির্বাচন ভালো হবে না। তবে এটা এখন বললেই আমি দেশদ্রোহী’। অবশ্য জাতীয় পার্টিও নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে এমন কোনও গ্যারান্টি নেই। নির্বাচনের পদে পদে জটিলতা বাড়ছে। বাড়ছে ধর্মীয় মৌলবাদীদের দাপটও।

ইতিমধ্যেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি চলে গিয়েছে জামায়াত-সহ বিভিন্ন মৌলবাদী সংগঠনের হাতে। ডাকসু ও জাকসুর ফলাফলই তার বড় প্রমাণ। শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ই নয়, প্রাথমিক স্তরেও ধর্মীয় উন্মাদনা ছড়ানো হচ্ছে। বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের নায়েবে আমীর মাওলানা মুজিবুর রহমান হামিদী বলেছেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নাচ-গানের শিক্ষক নিয়োগের ইসলাম বিদ্বেষী সিদ্ধান্ত বাতিল করে অবিলম্বে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষক নিয়োগ দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তাঁর মতে, এদেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৯০ ভাগ শিক্ষার্থী মুসলিম পরিবারের সন্তান। ঢাকায় বিশাল মিছিলও করেছেন তাঁরা। বিভিন্ন জায়গায় নারী স্বাধীনতার বিপক্ষে চলছে প্রচার।

অনির্বাচিত সরকারের আমলে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা দুঃসহ হয়ে উঠেছে। জিনিসের দাম আকাশছোঁয়া। কলকারখানা ধুঁকছে। বাড়ছে চুরি-ডাকাতি। উপদেষ্টাদের কাজকর্মে বিরক্ত অনেকেই। ঐকমত্য কমিশন নিয়েও অনৈক্য প্রকট। সংস্কারের নামে ‘কূসংস্কার’ চলছে বলেও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা কটাক্ষ করছেন। বহুল চর্চিত ‘জুলাই সনদ’ নিয়েও মতভেধ রয়েছে উপদেষ্টাদের মধ্যেই। এই অবস্থায় মুহাম্মদ ইউনূস নির্বাচন নিয়ে প্রতিশ্রুতি দিলেও তা কতোটা বাস্তবায়িত হবে সেটাই বড় প্রশ্ন। বিশেষ করে যে দেশে পুলিশ থানার ভিতরেই আক্রান্ত হয়, বিচারপতিদেরও অনায়াসেই পাঠানো যায় জেলযাত্রায়, সেখানে সুষ্ঠু নির্বাচন আশা করাটাই কষ্ঠকল্পিত।

মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন ঠিকই, ‘দেশের গণতন্ত্রে একটি নতুন যুগের সূচনা করবে।’ সেই ‘নতুন যুগ’ কেমন হবে, তা নিয়েও সংশয় কম নেই। অনেকেই ভেবেছিলেন আওয়ামী লীগের অবসান ঘটলে দেশবাসীর ভালো হবে। কিন্তু গত এক বছরেই মানুষের ধারনা বদলেছে। বেড়েছে হতাশা। তাই মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতিশ্রুতিতেও নির্বাচন নিয়ে কাটছে না সংশয়।

Address

3721 2nd Street
Saltlake Sector V, Kolkata 700 091

Contacts

+91 98300 71925
Contract.subhendu.etv@gmail.com